1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘অল্প বয়সে বিয়ের কারণে বহু মেয়ের পড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’

সমীর কুমার দে ঢাকা
২২ জানুয়ারি ২০২১

মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে মোহছেনা আক্তার এখন ঢাকার যাত্রাবাড়ির জান্নাতুল বানাত মহিলা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ৷ মাদ্রাসায় মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সমাজের বিভিন্ন বাস্তবতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি৷

https://p.dw.com/p/3oGYV
বাংলাদেশের একটি মাদ্রাসা
মাদ্রাসায় ক্লাস চলছে (ফাইল ছবি)

ডয়চে ভেলে : মাদ্রাসায় কবে থেকে মেয়েরাও পড়ছে?

মোহছেনা আক্তার : আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি৷ যখন থেকে আমরা মাদ্রাসায় পড়ি তখনই মেয়েদের আমি মাদ্রাসায় পড়তে দেখেছি৷ ছোটবেলায় আমি দেখেছি, মক্তবে বা মসজিদে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে পড়তে যেতো৷ তবে এক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম৷ আমি ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পড়েছি৷ কিন্তু তার আগে ১৯৯০-১৯৯১ সালের দিকেও মেয়েরা মাদ্রাসায় পড়তে যেতো৷ আমি নিজে কিন্তু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়ে তারপর মাদ্রাসায় পড়তে গেছি৷ তখন সবাই স্কুলে কিছুদিন পড়ে তারপর মাদ্রাসায় পড়তে যেতো৷ তখন মেয়েদের মাদ্রাসা শিক্ষাটা অনেকটাই কঠিন ছিল৷ সাধারণ শিক্ষায় মেয়েদের জন্য বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ ছিল৷ কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষায় মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ তেমন প্রেক্ষাপটেই ১৯৯৭ সালে আমাদের এই জান্নাতুল বানাত মহিলা আলিম মাদ্রাসা তৈরি হয়৷ 

বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলে আর মেয়েদের অনুপাতটা কেমন?

আমি যে প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছি সেটা পুরোটাই মেয়েদের৷ তবে ছেলে-মেয়েদের সমন্বিত যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেখানে মেয়েদের সংখ্যাটা আসলেই কম৷ সেখানে হয়ত ৭০ ভাগ ছেলে আর ৩০ ভাগ মেয়ে থাকতে পারে৷ আমরা যখন পড়তাম তখন এমনই ছিল৷ এখন মেয়েরা অনেকটাই এগিয়ে আসছে৷

‘অনেক অভিভাবক এখন মেয়েদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন’

আপনার প্রতিষ্ঠানে কতজন মেয়ে পড়াশোনা করে?

আমার প্রতিষ্ঠানটি পুরোটাই মেয়েদের৷ এখানে শুরু থেকে একেবারে আলিম পর্যন্ত পড়ানো হয়৷ এখানে সাড়ে ৪শ’র বেশি মেয়ে আছে৷

মেয়েদের মধ্যে মাদ্রাসায় পড়ার আগ্রহ কি বাড়ছে ,না কমছে?

এটা আসলে পুরোটাই নির্ভর করে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর৷ আমার যেটা মনে হচ্ছে, এখন অনেকেই মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে৷ মাদ্রাসা শিক্ষায় একমাত্র দুনিয়াদি সফলতা ও আখেরাতি সফলতা মেলে৷ সাধারণ শিক্ষায় দুনিয়াদি সফলতা মিললেও আখেরাতি সফলতা পাওয়া যায় না৷ অনেক অভিভাবক এখন মেয়েদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন৷

ছাত্রীদের মধ্যে কতভাগ শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যায়?

শহরে একটু বেশি, কিন্তু গ্রামে অনেক কম৷ সর্বোচ্চ ১০ ভাগ উপরের দিকে যেতে পারে৷ বাকিরা দাখিল, আলিম পর্যন্ত যেতে পারে৷ অনেকেই ফাজিল পর্যন্ত যেতে পারে না, তার আগেই ঝরে যায়৷

যারা ঝরে পড়ে, তাদের মাঝপথে লেখাপড়া থামিয়ে দেয়ার মূল কারণগুলো কী কী?

মূল কারণগুলোর অন্যতম বিয়ে হয়ে যাওয়া৷ আবার অনেকের আর্থিক সমস্যার কারণেও পড়াশোনা থেমে যায়৷ উচ্চ শিক্ষার জন্য দূরে যেতে হয়, গ্রামে কাছাকাছি মাদ্রাসা না থাকায় অনেক বেশি খরচ হয়৷ সেই খরচ হয়ত তারা বহন করতে পারে না৷ বিয়ের পর অনেক মেয়েই আর পড়তে পারে না৷

আপনাদের এখানে কি মেয়েদের লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ করার কোনো ব্যবস্থা আছে?

আমাদের একটা প্রজেক্ট আছে এতিমখানা৷ আমরা অনেক শিক্ষার্থীকে পুরো ফ্রি বা অর্ধেক ফ্রি করে দিয়ে থাকি৷ আমাদের এখানে প্রতি বছরই ১০ থেকে ২০ জন বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী থাকে৷ সরকারি নিয়ম অনুযায়ি তাদের পুরো ফ্রি পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়৷ এছাড়া দরিদ্র যারা আছেন, তাদেরও বিবেচনা করে পুরো ফ্রি বা অর্ধেক ফ্রি করে থাকি৷

আপনি এখানে অধ্যক্ষ হিসেবে কতদিন আছেন?

প্রায় ৬ বছর৷

এই মাদ্রাসায় পড়ে সফল হয়েছেন এমন কয়েকজনের কথা বলতে পারবেন?

একজন আছেন নাশিদ কামাল রায়হানা, ডা. আমেনা৷ রায়হানা পল্লী বিদ্যুতে বড় পদে চাকরি করছেন৷ আর আমেনা আছেন গেন্ডারিয়ার আসগড় আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷

মেয়েদের মাদ্রাসায় পড়তে কী কী প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়?

এখন আসলে অনেক প্রতিকুলতাই ওভারকাম করে আসা যাচ্ছে৷ একটা সময় অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল৷ এখন অতটা নেই বলেই আমি মনে করি৷ সাধারণ শিক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী পড়ে, তাদের অভিভাবকরা তো মাদ্রাসা শিক্ষাকে একটু অন্য চোখে দেখেন৷ তারা বলেন, মাদ্রাসায় পড়ে কী হবে? এই কারণে তারা সন্তানদের মাদ্রাসায় আনতে চান না৷ আমাদের এখানে পড়ে যারা ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের পরিবারের ধ্যান-ধারণা পাল্টে গেছে৷

আপনি নিজেও তো মাদ্রাসায় পড়েছেন, কিভাবে সেই প্রতিকূলতা জয় করেছেন?

আমারও প্রতিবন্ধকতা এসেছিল৷ আলিমের পর হয়ত আমার আর পড়াই হতো না৷ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল পারিবারিক কারণেই৷ বিশেষ করে আমাদের গ্রাম এলাকাগুলোতে তো মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করাই হয় না৷ আসলে আমার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়৷ নিজের ইচ্ছা এবং স্বামীর আগ্রহেই আমি মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করি৷ আমার স্বামী একটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক৷ উনিও মাদ্রাসা লাইনেই পড়াশোনা করেছেন৷ মাদ্রাসার পাশাপাশি উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে অনার্স-মাস্টার্সও করেছেন৷ বিয়ের সময় আমি তাকে বলেছিলাম, আমার পড়া যেন বন্ধ না করা হয়৷ উনি উনার কথা রেখেছেন৷  

বাংলাদেশের মাদ্রাসা ছাত্রীদের যৌনশিক্ষা

আপনার সহপাঠিনীদের মধ্যে কতজন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছেন?

আমার সঙ্গে যারা পড়েছে তাদের দু-একজনের কথা আমি বলতেই পারি, তারা আমার চেয়েও মেধাবী ছিল, কিন্তু ক্লাস এইটে তাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে আর পড়ালেখা হয়নি৷ এখন অনেক অভিভাবকই পড়ার গুরুত্বটা বোঝেন৷ কিন্তু আগে অনেক অভিভাবক সচেতন ছিলেন না৷ ফলে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতেন৷ আমার পুরো ব্যাচের মধ্যে একমাত্র আমিই কামিল পর্যন্ত শেষ করেছি৷ 

যারা লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তারা কি মাদ্রাসাতেই পড়েছেন? নাকি কেউ মূল ধারার শিক্ষায় চলে গেছেন?

অধিকাংশ মেয়ে মাদ্রাসাতেই পড়েছে৷ অনেকে আবার মাদ্রাসার পাশাপাশি জেনারেল লাইনেও অনার্স, মাস্টার্স করেছে৷

যেসব নারী মাদ্রাসায় পড়েন, তাদের বেশিরভাগ কী ধরনের পেশা বেছে নেন?

আমার মনে হয়, অধিকাংশই শিক্ষকতা পেশা পছন্দ করেন৷ পাশাপাশি যারা অনার্স, মাস্টার্স করেন তারা কোন বিষয়ের উপর পড়েছেন সেভাবে পেশা বেছে নেন৷ অধিকাংশই শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন৷

মাদ্রাসায় পড়ার পর নারীদের কী ধরনের চাকরির সুযোগ থাকে?

এখন তো মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরো ব্যাপক করা হয়েছে৷ আলাদা বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স করার মতো সুযোগ এসেছে৷ একটা সময় এই সুযোগ ছিল না৷ এখন যারা আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদ্রাসায় অনার্স মাস্টার্স করছে, তাদের চাকরির ক্ষেত্রে খুব বেশি বাধা থাকছে কি-না আমি বলতে পারবো না৷ তবে অধিকাংশই শিক্ষকতা পেশা বেছে নিচ্ছেন৷ এছাড়া ইসলামিক ভাবধারার যে ব্যাংকিং আছে সেখানেও অনেকে চাকরি পাচ্ছেন৷ আমার জানা মতে, আমারও দু’একজন স্টুডেন্ট ব্যাংকে চাকরি করছে৷