1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঋণের চাপে আত্মহত্যা বাড়ছে কেন?

সমীর কুমার দে ঢাকা
৫ মার্চ ২০২৪

ঋণের চাপে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। সর্বশেষ সোমবার মেহেরপুরে একজন গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। আরও একজন ব্যবসায়ী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন৷

https://p.dw.com/p/4dBxK
এক তরুণী ল্যাপটপের সামনে বসে আছেন
বাংলাদেশে ঋণের চাপে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছেছবি: Olivier Douliery/AFP/Getty Images

এক সপ্তাহ আগে মুন্সীগঞ্জে দুই সন্তান নিয়ে একজন গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু ঋণের চাপে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার কারণ কী?

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখানে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। যার ন্যূনতম একটা সম্মানবোধ আছে, তিনি হয়ত আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু আমাদের দেশে তো হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে অনেকেই আয়েসে জীবন যাপন করছেন। তাদের ঐ সম্মানবোধটাই নেই। এখন পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে গরিব আরো গরিব হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেকে জীবন বাঁচাতে ঋণ নিয়ে সেটারই ফাঁদে পড়ছে। যার ফলে এই ধরনের ঘটনায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।’’

মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার নাজিরাকোনা গ্রামের নুর আলীর স্ত্রী নুরজাহান খাতুন এনজিওর ঋণের কিস্তির চাপে (৪২) গলায় ফাঁস দিয়ে লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আটটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলে নুরজাহান। একটা থেকে ঋণ নিয়ে আরেকটা শোধ করত। এভাবে করতে করতে তারা আর শোধ করতে পারেনি। ঋণের কিস্তির জন্য যখন চাপ দিচ্ছে, তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টুকটাক বেধে যেত। শুধু নুরজাহান নয়, ঋণের চাপে আমার গ্রামের চরটি পরিবার পালিয়ে গেছে। এনজিওগুলো যেভাবে জাল বিছিয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের সেখান থেকে বের হয়ে আসা খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”

‘একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিলে তো ফাঁদে পড়তেই হবে’

এনজিও বা মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ কীভাবে কমানো যায়? জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এনজিও থেকে যে ঋণটা একজন নিচ্ছে, অন্যজন সেটা জানে না। কারণ তাদের ঋণের কোন কেন্দ্রীয় সার্ভার নেই। যেমন ধরেন একটি ব্যাংক থেকে আপনি যদি ঋণ নেন, সেটা সর্ভারে পরীক্ষা করলেই পাওয়া যাবে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে একজনের নামে একটি ঋণ থাকলে অন্য ব্যাংক সাধারণত আর দেয় না । কিন্তু গ্রামের একজন মানুষকে ৮-১০টি এনজিও ঋণ  দিচ্ছে। তার হয়ত সেই ঋণ শোধ করার সামর্থ্যই নেই। তাহলে তিনি দেবেন কীভাবে? এজন্য আমরা বলছি, ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রেও একটা কেন্দ্রীয় সার্ভার থাকা প্রয়োজন। এবং কোন ব্যক্তিকে একাধিক এনজিও ঋণ দিতে পারবে না। এগুলো নিশ্চিত করতে না পারলে সংকট আরও বাড়বে।’’

একই দিনে মেহেরপুরের গাংনীতে ঋণের কিস্তির টাকা দিতে না পেরে বিষপান করেছেন রিপন হোসেন (৩২) নামের একজন ব্যবসায়ী। যদিও তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। রিপন আলী গাংনী উপজেলার গাঁড়াবাড়িয়া গ্রামের হাটপাড়া এলাকার বাসিন্দা। কেন এমন করলেন? জানতে চাইলে রিপন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি মাংসের ব্যবসা করি, পাশাপাশি আমার একটা জুয়েলারিও আছে। আমি তিনটি এনজিও থেকে ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। একটা এনজিও থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছি। প্রতিমাসে সেখানে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়। এটা এক বছরে শোধ হওয়ার কথা। আরেকটা থেকে ৯৫ হাজার টাকা নিয়েছি, সেখানে মাসে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। এটাও এক বছরে শোধ হওয়ার কথা। আরেকটা থেকে নিয়েছি ৭০ হাজার টাকা। সেখানে সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এটা ৫ মাসে শোধ হওয়ার কথা। জুয়েলারি ব্যবসায় আমার ৬ লাখ টাকার মতো বাকি আছে। সেই টাকা তুলতে পারছি না, আবার এনজিওগুলোও ঋণের কিস্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। এ কারণে এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার জন্য বিষপান করেছিলাম।”

গত ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় সায়মা বেগম (৩৫) তার মেয়ে ৯ বছরের ছাইমুনা এবং সাত বছরের ছেলে তাওহীদকে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি ঋণের চাপে আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণের জ্বালা সইতে না পেরে সিরাজুল ইসলাম (৫৫) নামে ঝিনাইদহের এক ব্যবসায়ী বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। সুদের যন্ত্রণা তার হৃদয় কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে, তা ফুটে উঠে লিখে যাওয়া শেষ চিরকুটে, "সুদখোরদের অত্যাচারে বাঁচতে পারলাম না। আমার জায়গাজমি, বাড়ি সব বিক্রি করে দিয়েছি। একেকজনের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া, তার সাত-আট-দশ গুণ টাকা দিয়েও রেহাই দিল না তারা। কেউ আবার কেস করেছেন, কেউ অপমান-অপদস্থ করছেন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না, তাই বিদায় নিলাম।’’

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই ব্যর্থতা রাষ্ট্রের। সরকার এত ব্যাংক দিয়েছে। তারপরও ৪২ থেকে ৪৫ ভাগ মানুষ এখনও ব্যাংকিং সেবার বাইরে। যারা ব্যাংকিং সেবার বাইরে তারা তো প্রয়োজন হলে এনজিও থেকে ঋণ নেবে। কারণ ব্যাংকের সঙ্গে তো তাদের সম্পর্ক নেই। আর একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিলে তো ফাঁদে পড়তেই হবে। শহরে বিভিন্ন কাজের সুযোগ থাকলেও প্রত্যন্ত গ্রামে অসহায় দরিদ্র মানুষ সমস্যায় আছে। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এসব দাদন ব্যবসায়ীকে নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি দেশের সব মানুষকে ব্যাংকিং সেবার মধ্যে আনতে হবে। তাহলে এই ধরনের পরিস্থিতি কমে আসবে।”

গত মাসের শুরুতে নীলফামারীর আশিকুর মোল্লা বাবু নামে একজন ব্যবসায়ী স্ত্রী ও দুই শিশুকন্যাকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। আশিকুরের চাচাতো ভাই জাকির হোসেন মোল্লা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাবার মৃত্যুর পর ব্যাংক থেকে নেওয়া ২২ লাখ টাকা ঋণ শোধ করতে গিয়ে আশিকুরের ব্যবসার পুঁজি শেষ হয়ে যায়। পাশাপাশি তিনি যে ব্যবসা করতেন, সেখানেও বড় ধরনের লস করেছেন। তার গোডাউনে রাখা রসুন সব পচে গেছে। মানসিক বিপর্যয় থেকে তিনি এ কাজ করেছেন বলে আমাদের বলেছেন।”

গত বছরের মে মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুস্তবা আলী আত্মহত্যা করেন। ঋণের চাপ সইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। মুস্তবা আলীর ছেলে আহমেদ ওয়াসিফ প্রিতুল সে সময় জানিয়েছিলেন, "তার বাবা ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্যুরো বাংলাদেশ, বীজ এনজিওসহ কয়েক জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ঋণের চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।” এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মাসুদ আলম, কিশোরগঞ্জের রোকন উদ্দিন, রাজশাহীর চারঘাটের মাছচাষি আবদুল কুদ্দুস, কুমিল্লার তিতাসের কড়িকান্দি বাজারের কলা ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার তাসলিমা আক্তারসহ অন্তত দুই ডজন মানুষ ঋনের কিস্তির চাপে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এমন ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে।

প্রসঙ্গত, এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেশীয় এনজিওর সংখ্যা ২ হাজার ৩১৮। এর মধ্যে অধিকাংশেরই আছে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে আছে মাল্টিপারপাস কোম্পানি, আছে নানা সমিতি ও দাদন ব্যবসায়ী। দেশের ৩ কোটি ৫২ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে। ঋণ নেওয়ার পরের সপ্তাহ থেকে কিস্তি আদায় শুরু হয়। কৃষকের জমিতে ফসল ভালো না হলেও ঋণগ্রহীতাকে ঘরের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ঘটিবাটি বিক্রি করে সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। যখন তাতেও কুলায় না, তখন ভিটেমাটি ও ঘর বিক্রি করতে হয়। এমনও বহু ঘটনা ঘটেছে যে, কিস্তি আদায়কারীরা ঋণের দায়ে ঋণগ্রহীতার ঘর ভেঙে নিয়ে গেছেন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য