1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

করোনাই কি বাঁচিয়ে দিল?

৯ মার্চ ২০২০

করোনা, নাকি বাংলাদেশের মাটিতে মোদী-বিরোধী আন্দোলন, কীসের জন্য বাতিল হল নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর, প্রশ্ন ঘুরছে কূটনৈতিক মহলে৷

https://p.dw.com/p/3Z5If
ছবি: AFP/P. Singh

আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর৷ শুধু মোদীই নন, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীরও সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু রবিবার রাতে বাংলাদেশ জানিয়ে দেয়, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে আপাতত কর্মসূচি ছোট আকারে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ ফলে বিদেশি অতিথিদেরও আপাতত ডাকা হচ্ছে না৷ বস্তুত, রবিবারেই বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে৷ ভারতে এখনও পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪২৷

এর আগে করোনার কারণে বাতিল হয়েছিল ইইউ-ইন্ডিয়া সম্মেলন৷ আগামী ১৩ মার্চ সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ব্রাসেলস যাওয়ার কথা ছিল নরেন্দ্র মোদীর৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে দুই তরফই করোনার কারণে সম্মেলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তবে ইইউ-ইন্ডিয়া সম্মেলন বাতিল আর বাংলাদেশ সফর বাতিল কি একই মোড়কে রাখা যায়? শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, গোটা উপমহাদেশেই এই প্রশ্ন উঠেছে৷ অনেকেই এর পিছনে রাজনৈতিক যুক্তি খুঁজছেন৷ তাঁদের বক্তব্য, করোনাকে এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হল৷

গত ডিসেম্বর মাসে ভারতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করেছে বিজেপি সরকার৷ যার অব্যবহিত পর থেকেই দেশ জুড়ে প্রবল আন্দোলন এবং বিক্ষোভ শুরু হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, এই আইন মুসলিম বিরোধী এবং দেশের সংবিধানের পরিপন্থী৷ এরই মধ্যে গত সপ্তাহে ঘটে গিয়েছে ভয়াবহ দিল্লি দাঙ্গা৷ নিহত হয়েছেন ৪৭ জন৷ এখনও নিখোঁজ অনেকে৷ এই দাঙ্গার জন্যেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে দায়ী করছেন দেশ এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চের একটি বড় অংশ৷ এরই মধ্যে মুজিববর্ষ পালনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছি্ল  নরেন্দ্র মোদীর৷ যার জেরে গোটা বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় মোদী-বিরোধী আন্দোলন৷ ঢাকায় তো বটেই, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মিছিল বার করে বিক্ষোভকারীরা৷ বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে আপত্তি স্পষ্ট হয়৷ মনে রাখা দরকার, এই আন্দোলন ভারতবিরোধী নয়, সোনিয়া গান্ধী কিংবা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কোনও আপত্তি জানাননি৷ আপত্তি উঠেছে কেবল মোদীর বিরুদ্ধে৷

কিন্তু কূটনৈতিক ভাবে ভারত-বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তাতে আমন্ত্রণ জানানোর পর মোদীর নিমন্ত্রণ ফেরত নেওয়া কার্যত সম্ভব ছিল না শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে৷ দুই দিন আগেও হাসিনার সরকার স্পষ্ট জানিয়েছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং তা ফেরানোর প্রশ্নই ওঠে না৷ কিন্তু ভারত এবং বাংলাদেশ, দুই পক্ষই বুঝতে পারছিল, এমন পরিস্থিতিতে মোদীর সে দেশে যাওয়া খুব আনন্দের হবে না৷ বিক্ষোভের আঁচ তাঁর উপরে পড়বেই৷

এমন এক পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাসকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল বলেই মনে করছে ভারতের রাজনৈতিক মহলের একাংশ৷ কারণ, ইউরোপ বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় করোনা যে ভাবে ছড়িয়েছে, ভারত কিংবা বাংলাদেশে তার প্রভাব মোটেই এখনও সে ভাবে পড়েনি৷ শুধু এই কারণেই এত বড় অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাওয়া অনেককেই অবাক করেছে৷ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘সিএএ, এনআরসি এবং দিল্লি দাঙ্গার কারণে কূটনৈতিক মহলে ভারত এখন এমনিই আইসোলেশনে চলে গিয়েছে৷ বিশ্ব জুড়ে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে৷ এমন অবস্থায় করোনাকে অজুহাত হিসেবে সামনে এনে সেই আইসোলেশনকে মান্যতা দেওয়া হল৷’’ 

সেলিমের মতো ততটা স্পষ্ট ভাবে না বললেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘কূটনীতিতে দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে সব সময় চার হয় না৷ বহু সময়েই নানা অজুহাত সামনে এনে মূল বিষয়টিকে ধামা চাপা দেওয়া হয়৷ এ ক্ষেত্রেও সে প্রশ্ন উঠছে সঙ্গত ভাবেই৷ তবে কোনও দেশই তা স্বীকার করবে না৷ ফলে করোনা অজুহাতই, এ কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না৷’’

আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু না বললেও, ভারতের বিদেশমন্ত্রকের সূত্র বলছে, করোনার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ তাদের অনুষ্ঠান বাতিল করেছে৷ ফলে প্রধানমন্ত্রীরও আপাতত সেখানে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে না৷ কিন্তু ভারত এই সফর বাতিল করেনি৷ ফলে করোনাকে ভারত অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, এই প্রশ্নটিই অবান্তর৷ বস্তুত, বৃহস্পতিবারই ভারতের বিদেশ মন্ত্রক আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দিয়েছিল মোদী বাংলাদেশ সফরে যাবেন৷

আলোচনায় উঠে আসছে আরও একটি যুক্তি৷ কূটনীতিবিদদের একাংশ বলছে, বাংলাদেশ সরকার বুঝতে পারছিল, এই সময়ে মোদীকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে না৷ ফলে করোনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে দেশের ভিতর তৈরি হওয়া বিক্ষোভকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ৷ ভারত সরকারের প্রাক্তন উচ্চপদস্থ আধিকারিক অমিতাভ রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘আজ সকালেই বাংলাদেশ থেকে একজন ফোন করেছিলেন৷ তিনি বললেন, আমরা বেঁচে গেলাম। পুরো বিষয়টি নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক হচ্ছিল, তাতে আশঙ্কা বাড়ছিল৷ এ ক্ষেত্রে করোনা সকলকেই বাঁচিয়ে দিল৷’’

দীর্ঘদিন ধরে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় ছাত্রের বক্তব্য, শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই এখন সফর করতে ভয় পাচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ ইইউ পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ থেকে অ্যামেরিকা সর্বত্র মোদী-শাহের বিভিন্ন পদক্ষেপ সমালোচনার মুখে পড়ছে৷ দিল্লি দাঙ্গার পরে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে৷ মোদী বুঝতে পারছেন, সর্বত্রই এখন তাঁকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে৷ যতই বিষয়গুলিকে তিনি অভ্যন্তরীণ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন৷ করোনা সত্যি সত্যিই ভারতকে অপ্রীতিকর প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে৷

দেখুন গত জানুয়ারির ছবিঘর...