1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

খাদ্য-জ্বালানির দ্বৈত সংকটের মুখে বাংলাদেশ

২৮ অক্টোবর ২০২২

বাংলাদেশ কি খাদ্য ও জ্বালানির দ্বৈত সংকটে পড়তে যাচ্ছে? প্রশ্নটা যৌক্তিক কারণেই এখন জোরালোভাবে উঠে আসছে বিশেষত যেখানে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট এখন খুব স্পষ্ট৷

https://p.dw.com/p/4Imn3
মুন্সীগঞ্জের রাইস মিলে কর্মরত নারী
দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে বলে সরকার ও নীতি-নির্ধারকেরা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন৷ বাস্তবতা অবশ্য তা বলে না৷ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষ আগামী বছরের প্রথমভাগেই বড় ধরনের খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়তে পারে বলে জোরাল পূর্বাভাসও মিলছে৷

খাদ্য সংকট নিয়ে সর্তক বার্তা এসেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে৷ গত প্রায় এক মাসে তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন তা এরকম: বাংলাদেশকে যেন দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়তে না হয়, তাই দেশের পতিত আবাদ জমির প্রতিটি ইঞ্চি কাজে লাগাতে হবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য৷ কারণ, সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট ও দুর্যোগ দেখা দেয়ার, দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ জনসাধারণকে খাদ্যের অপচয় বন্ধ করতে ও নিজেদেরকে যার যেখানে যতটুকু সম্ভব খাদ্য উৎপাদনের চেষ্টা করারও আহবান জানিয়েছেন তিনি৷

শেখ হাসিনার এই সতর্কবার্তা তাৎপর্যপূর্ণ৷  বস্তুত এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা অদূর ভবিষ্যতে বিশেষত ২০২৩ সালে দুনিয়াজুড়ে বড় ধরনের খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ার কথা জানিয়েছে৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্বব্যাংক যখন প্রায় একই সুরে বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আগাম বড় ধরণের দু:সংবাদ শোনায়, তখন চিন্তিত না হয়ে পারা যায় না৷

খাদ্য সংকটের নেপথ্যে

বেশিরভাগ মানুষই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে আসন্ন খাদ্য সংকটের প্রধান কারণ মনে করছে৷ অথচ গত এক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ ও সংঘাত ওখানকার কোনো কোনো দেশে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে আগেই৷ ছয় বছর ধরে সংঘাত ও হামলার মধ্যে থাকা ইয়েমন হলো তার একটি উদাহরণ৷ করোনা ভাইরাস মহামারির ধাক্কায় বিভিন্ন দেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে যা সংকটে রূপ নিতে পারে৷ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতের ফলে বিভিন্ন এলাকায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টিও সম্প্রতি দশকে জোরাল হয়ে উঠেছে৷

এসব মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক বিপরযয়ের পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ খাদ্য নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতি কিছু দেশে খাদ্য সংকট তৈরি করেছে৷ যেমন: শ্রীলঙ্কা৷ ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে রাসায়নিক সার ব্যবহার বন্ধ করে পুরোপুরি জৈব সার দিয়ে কৃষি উৎপাদনের নীতি গ্রহণ করে দেশটি৷ এতে খাদ্য উৎপাদন কমে যায়৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০২১ সালে রাসায়নিক সার ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও ততোদিনে বড় বিপরযয় ঘটে গেছে যা দৃশ্যমান হয় এ বছরের প্রথম দিক থেকে৷ দেশটি খাদ্যের মূল্যস্ফীতি এ বছরের জুলাই মানে ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়৷ আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়ায় বিশ্ব বাজার থেকে খাদ্য কেনার প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে দেশটিতে৷

তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা কী? খাদ্যের জন্য বাংলাদেশ যেহেতু অনেকটাই বিশ্ব বাজারের ওপর নির্ভরশীল, তাই  বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি কিছুটা ব্যহত হলেই তা দেশের ভেতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে -- অতীতে বিভিন্ন সময়ে এটা দেখা গেছে৷ যদিও দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে বলে সরকার ও নীতি-নির্ধারকেরা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন৷ যেমন: অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন: ‘‘রূপকল্প ২০২১-এ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য ঘাটতি দূর করা এবং দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল, তা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এরই মধ্যে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে৷’’ [পৃ-১০, বাজেট বক্তৃতা, অর্থ মন্ত্রণালয়; জুন ৯, ২০২২]

বাস্তবতা অবশ্য তা বলে না৷ সাধারণত কোনো দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মানে হলো দেশটি নিজস্ব খাদ্য চাহিদা মেটানোর পুরোটাই দেশে উৎপাদন করা হয়৷ সেটি হলে, দেশটির খাদ্য আমদানি করার কথা নয়৷ অথচ, বাংলাদেশ প্রতিবছরই খাদ্য আমদানি করছে৷ যদি শুধু খাদ্য শস্য (চাল ও গম) আমদানির কথাই ধরা হয়, তাহলেও দেখা যায় যে গত এক দশকে বেশিরভাগ বছরেই খাদ্যশস্য আমদানি আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে৷  অন্যান্য খাদ্যপণ্য যেমন ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, মশলা, গুড়ো দুধ আমদানিও বেড়েছে৷ আমদানি বাড়ার সহজ কারণ হলো দেশের ভেতরের উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়৷

জ্বালানি সংকট থেকে বিদ্যুৎ বিপর্য

অন্যদিকে দেশে জ্বালানি সংকট এখন খুবই স্পষ্ট৷ প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবার কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন যে প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ রেখে শিল্পখাতে গ্যাস দেয়া হবে৷ কারণ, গ্যাস-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ইতিমধ্যেই সংকটের মধ্যে পড়েছে৷ তাই শিল্পে গ্যাস জোগান দিতে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হবে৷  তিনি আরো বলেছেন যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে অবস্থা, তাতে বাড়তি দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি তথা তরলীকৃত প্রাকৃতি গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়৷

অথচ মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে এই উপদেষ্টাই আমদানি-নির্ভরতার জন্য বিদ্যুৎ সংকটের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছিলেন৷ বাস্তবতা হলো, অনেকটা তার পরামর্শ মেনে ২০১৫ সালে থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে দ্রুত হাঁটতে থাকে বাংলাদেশ, অগ্রাহ্য করা হয় অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে৷

আর এটা সবারই জানা জ্বালানি গ্যাস ও তেলের বিশ্ববাজার বরাবরই স্পর্শকাতর ৷ আর তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে এই বাজারকে অস্থির ও ব্যয়বহুল করে তুলেছে তা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়৷ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, আরো কমিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে৷ রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপ এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াচ্ছে বিকল্পে হিসেবে৷ হঠাৎ এলএনজির চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়ে তা ব্যয়বহুল হয়ে গেছে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য৷

যদি পরযাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতো, তাহলে হয়তো এলএনজি আমদানি করে আরো কয়েকমাস চালানো যেতে৷ তবে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়ে গেছে৷ এ বছর জুন মাস শেষে যেখানে রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার, তা অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে নেমে এসেছে প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারে৷ তাই সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যেন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যায়৷ জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়ে ফেলা করা তার একটা অংশ৷

বস্তুত আসন্ন খাদ্য সংকট ও বিরাজমান জ্বালানি সংকটের জন্য অদূরদর্শী আমদানি নির্ভরতার নীতি যে বহুলাংশে দায়ী তা এখন স্পষ্ট৷ সম্ভবত ধরেই নেয়া হয়েছিল যে বিশ্ববাজার বরাবরই স্থিতিশীল থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অটুট থাকবে৷ আর তাই আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না৷ তারপরও যখন সমস্যার আভাস মিলছিল, তখনো'সবকিছু ঠিক আছে' নীতি অনুসরণ করা হয়েছে৷ এখন যখন দ্রুত রিজার্ভ ক্ষয়ে যাচ্ছে স্বল্পমেয়াদি অথচ উচ্চ সুদের বেসরকারি ঋণ পরিশোধ করতে এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াতে, তখন সবকিছু আর ঠিক থাকছে না৷

আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিক
আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিকছবি: Privat

তাহলে এখন কী হবে?

খাদ্য উৎপাদন একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া৷ আজকে বীজ বপন করলে কয়েক সপ্তাহের আগে কোনো ফলন হবে না প্রাকৃতিক নিয়মে৷ এমতাবস্থায় সরকার পতিত জমি চাষাবাদে কিভাবে ও কতো দ্রুত উদ্যোগী হয়, তাও দেখার বিষয়৷ 

এদিকে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে৷ তার ওপর খাদ্য রপ্তানিকারক অনেক দেশই রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণারোপ করেছে, সামনে আরো করবে৷ বেশি দাম দিয়েও আগামীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল নাও মিলতে পারে৷ সামনে কি তাহলে খাদ্য আমদানিও কমাতে হবে বাংলাদেশকে? আবার দেশে চালের উৎপাদন এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি৷ আবার আগামী মৌসুমেও উৎপাদন কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে উপকরণ ঘাটতি ও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে৷ তার মানে দেশি-বিদেশি উভয় উৎস থেকেই খাদ্যের জোগান অনেকটা কমে যাবে তা প্রায় নিশ্চিত৷

এমতাবস্থায় শুধু আশ্বাস দিয়ে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা যাবে না৷ খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে৷ বাজারে প্রায় সবধরণের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে৷ খাদ্য মজুদ ও জোগান যতো কমতে থাকবে, দাম ততো বাড়বে৷ তাতে করে যদি একবার জনমনে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে যে সামনে খাদ্য পাওয়া কঠিন হবে বা আকাল দেখা দিবে, তাহলে লোকজন যে যার মতো খাদ্য মজুদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে৷ এরকমটা দেখা গিয়েছিল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের একেবারে প্রথম দিকে৷ এই ভীতিজনিত ক্রয় (প্যানিক বাইং) কাঙ্খিত না হলেও জ্বালানি সংকটের জন্য বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি মানুষজনকে হয়তো সেদিকেই ঠেলে দিতে পারে৷ কারণ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎতো মজুদ করা যায় না, তবে চাল-ডাল-নুন-তেলতো কিছু হলেও কিনে রাখা যায়!

অন্যভাবে বললে, খাদ্য ও জ্বালানি নিয়ে এসব সতর্কবার্তা দেয়ার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধির বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই নাজুক হয়ে পড়ছে৷ আর তার নেপথ্যে রয়েছে ব্যবস্থাপনগত ত্রুটি ও সঠিক নীতির অভাব, রয়েছে অটেকসই প্রবৃদ্ধির অসম বন্টন৷