1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দুর্নীতির দুষ্টচক্রে আবদ্ধ দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমই থাকে

১৭ জুন ২০২২

বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি সূচকের সাথে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার জন্য রাষ্ট্রীয় বা সরকারি বরাদ্দ, সুবিধা এবং মানের একটি সম্পর্ক আছে৷

https://p.dw.com/p/4Cq02
Symbolbild Bangladesch Korruption Banknoten Geld Bestechung
ছবি: DW

সম্পর্কটি পরস্পর বিপরীতমুখী৷ একটি উর্ধ্বমুখী হলে অন্যটি নিম্নগামী হয়৷ বিশ্বের যেসব দেশে এই দুটি খাতে সরকারি বরাদ্দ বেশি, সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত, রাষ্ট্র নাগরিকের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয় সেসব দেশে দুর্নীতি কম৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও নরওয়ে এই চারটি দেশ ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ৷ এক বছর নয়, টানা অনেক বছর ধরে এই দেশগুলোতে দুর্নীতি কম৷ এই চারটি দেশ শিক্ষা খাতে জিডিপির ছয় থেকে সাড়ে সাত শতাংশ পর্যন্ত খরচ করে৷ আর স্বাস্থ্য খাতে এই বরাদ্দ আরও বেশি, নয় থেকে ১০ শতাংশ৷ বিপরীতভাবে যে দেশগুলোতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কম, সুযোগ-সুবিধা নিম্নমানের, এই দুই খাতের বাণিজ্যিকীকরণ বেশি, নাগরিকদেরকে এই দুই খাতের সেবা গ্রহণের জন্য প্রচুর পরিমাণ অযাচিত অর্থ খরচ করতে হয় সেসব দেশে দুর্নীতি বেশি৷ দুর্নীতি সূচকের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করা তিনটি দেশ হলো দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও ভেনেজুয়েলা৷ এই তিনটি দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.৩ থেকে ১.৫ শতাংশ আর স্বাস্থখাতে বরাদ্দ দুই থেকে তিন শতাংশ৷ দুর্নীতি সূচকের ক্ষেত্রে খারাপ অবস্থানে আছে এমন ৯৮ থেকে ৯৯ ভাগ দেশের ক্ষেত্রে এই অনুসিদ্ধান্ত আপনি মিলিয়ে নিতে পারেন৷ ফলাফল একই আসবে৷ উপরন্তু যেসব দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গত কয়েক বছরে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, সুযোগ-সুবিধার প্রসার ঘটছে সেসব দেশের দুর্নীতির সূচকে অবস্থানের উন্নতি ঘটছে৷ বিষয়টিকে অন্যভাবে বলা যায়, রাষ্ট্র যখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমায়, সুবিধাগুলো সঙ্কুচিত করে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকরা যখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয় তখন রাষ্ট্রের নাগরিকরা দুর্নীতির দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে৷

বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে গত কয়েক বছরের বরাদ্দ জিডিপির ১.৩ শতাংশ থেকে দুই আর স্বাস্থ্য খাতে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত৷ এই দুটি খাতে বিশ্বের যেসব দেশে বরাদ্দ কম তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ অন্যদিকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭৷ অর্থাৎ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধার সাথে দুর্নীতির সম্পর্কটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য৷

বাংলাদেশে কনস্টেবল থেকে আইজিপি, পিয়ন থেকে সচিব, সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোনো পর্যায়ে ছোট থেকে বড় কর্তা সবাই নিজেদের সন্তানকে ভাল স্কুল-কলেজে পড়াতে চান, মানসম্মত শিক্ষা দিতে চান৷ প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ যে কোনো পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা ব্যক্তির ইচ্ছা ও সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কথা নয়৷ এটি প্রত্যেকটি শিশুর জন্মগত অধিকার যা নিশ্চিত করার কথা রাষ্ট্রের৷ রাষ্ট্র সকল শিশুকে সমান চোখে দেখে প্রত্যেক শিশুর জন্য একই ধরনের শিক্ষা নিশ্চিত করবে৷ এটাই যে কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের মূলনীতিগুলোর অন্যতম৷ কিন্তু বাংলাদেশে আমরা কি দেখি? সরকারি অপর্যাপ্ত বরাদ্দ, মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, আধুনিক শিক্ষা উপকরণের সঙ্কটে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল-কলেজগুলো এক সময়ের গৌরব প্রায় হারিয়ে ফেলেছে৷ ফলে উচ্চ বেতন, ডোনেশেন, ভর্তি ফি দিয়ে অভিভাবকরা ছুটেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে৷ এসব প্রতিষ্ঠানে বাচ্চাকে পড়াতে গিয়ে বছরে ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করছেন অভিভাবকরা৷ বাংলাদেশে কোন সরকারি কর্মকর্তা বছরে ৫০ লাখ টাকা আয় করেন? তাহলে তাদের সন্তানরা কিভাবে এত টাকা বেতনের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন? শুধু স্কুলের বেতন নয়, প্রাইভেট পড়ার খরচ হিসেব করলে এই খরচ আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়৷ আবার স্বাস্থ্য খাতের কথা চিন্তা করুন৷ বাংলাদেশে এমন কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই যেখানে ক্ষমতাধর হওয়া ছাড়া বা বিনা তদ্বিরে আপনি ভাল চিকিৎসা পেতে পারেন৷ ফলে বাধ্য হয়েই জ্বর থেকে ক্যান্সার সব রোগের জন্য মানুষকে ছুটতে হয় বেসরকারি চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলোতে যেখানে গুণতে হয় কাড়ি কাড়ি টাকা৷ রাষ্ট্র বা সরকার যখন নাগরিকের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে না, যখন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা মৌলিক অধিকারের খাতগুলো ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয় তখন নাগরিকরা আপনাআপনিই দুর্নীতির চক্রে ঢুকে পড়ে৷ আর একবার ঢুকলে সেই চক্রে তার বিচরণ বাড়তেই থাকে৷ দুর্নীতি পর্যায়ক্রমে ব্যক্তি থেকে ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে৷ ব্যষ্টিক পর্যায়ের অভাব আর সঙ্কট যখন ধীরে ধীরে সামষ্টিক রূপ লাভ করে তখন সে সঙ্কট থেকে উত্তরণের গোপন পথটি সমাজের অভ্যাসে পরিণত হয়৷  

Infografik Anteil Bildunsgausgaben vom BIP in ausgewaehlten asiatischen Ländern BN

প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য শিক্ষাবিদ, গবেষকসহ সবার পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয়৷ এবার খোদ শিক্ষামন্ত্রীই বলেছিলেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ জিডিপির ছয় ভাগে যেতে হবে৷ টাকার অঙ্কে বাংলাদেশের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বেড়েছে৷ এই অর্থবছরে মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ কিন্তু জিডিপির হিসাবে এই বরাদ্দ আশাব্যঞ্জক কিছু নয়৷ জিডিপির এত কম বরাদ্দ শিক্ষা খাতে রেখে পৃথিবীতে নিজেদের ভাগ্য উন্নত করতে পেরেছে এমন একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ বরং গত ২০ বছরে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল আর উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া দেশগুলোর রেকর্ড বলছে, শিক্ষা খাতে তারা সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়ার কারণেই নিজেদের ভাগ্য উন্নত করতে পেরেছে৷ দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কম৷ বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দের বেশিরভাগ চলে যায় বেতন-ভাতা আর অবকাঠামোর পেছনে৷ এরপর যা থাকে তা দিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি এক-দুই লাখ টাকার বেশি পায় না৷ এ অর্থ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করা গরীবের ঘোড়ারোগ ছাড়া আর কি!

শিক্ষা খাতে বরাদ্দের সুফল কৃষি বা শিল্পের মত প্রত্যক্ষ নয়, বরং এটি পরোক্ষ এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী৷ টানা ১০ বছর ধরে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করলে তার সুফল পাওয়া যাবে আরও ১০ বছর পর৷ বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উন্নয়নের নীতি হলো তাৎক্ষণিক এবং ক্ষণজন্মা নীতি যেটির সুফল সহসা দৃশ্যমান হবে৷ কারণ তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত থেকে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ফায়দা চান৷ তাই অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এমন কোনো বার্তা নেই যেখান থেকে ধরে নেয়া যায় শিক্ষা সরকারের একটি অগ্রাধিকার খাত৷ শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত একটি খাত হলো গবেষণা যেটির গুরুত্ব বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের রাডার অবধি পৌঁছায়নি কখনই৷ নেপালের মত দেশও গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে আলাদা বরাদ্দ দিয়ে থাকে৷ গবেষণা ও উন্নয়নকে আলাদা খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয় এমন ১২৫টি দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নুতন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নতুন ভবন হচ্ছে, কিন্তু গবেষণার ভিত্তি স্থাপন হচ্ছে না৷

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকছবি: bdnews24.com

শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার৷ এগুলোর সাথে মানুষের জীবন ও ভাল থাকার সংযোগ সরাসরি জড়িত৷ এসব অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যখন রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কম থাকে, রাষ্ট্র যখন মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বেসরকারি ও বাণিজ্যিক খাতে ছেড়ে দেয় তখন তা সিস্টেমেটিক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়৷ বাংলাদেশের মত যেসব দেশে দুর্নীতি বেশি সেসব দেশে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়৷ সেটি হলো এসব দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করা হয়৷ কারণ এসব দেশে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীরাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যবসার সাথে জড়িত৷ আবার বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা ও ব্যবসায়ীর সন্তান দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে না৷ তারা দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত দেশীয় অর্থে বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসছে৷ তারাই আবার মানুষের মৌলিক অধিকার খাতগুলোর নীতিনির্ধারক হচ্ছে৷ সমষ্টিক পর্যায়ের দুর্নীতি ধীরে ধীরে ব্যষ্টিক পর্যায়ে দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে যাতে একটি দুষ্টচক্র আবদ্ধ হয়ে পড়েছে গোটা দেশ৷ পৌরসভার মেয়রের জন্য দুই কোটি টাকা দিয়ে সরকার গাড়ি কিনছে৷ সেই পৌরসভার মেয়র কিংবা তার নিকটজনেরা নিজস্ব অর্থায়নে উপশহরে বেসরকারি স্কুলের নামে ব্যবসা খুলে বসেছে৷ সাথে চলছে কোচিং ব্যবসা৷ একইসাথে সেই পৌরসভার মেয়রের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর কাছে উপবৃত্তির মাত্র ১২৫ টাকা তুলে দিয়ে উন্নয়নের স্তবক শুনানো হচ্ছে৷ এ দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক বলিষ্ঠতা দরকার সেটি আপাতত বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের আছে বলে মনে হয় না৷ নিদেনপক্ষে শিক্ষা খাতের বেলায় যে নেই সেটি বলা যায় বাজেটে এই খাতের বরাদ্দ দেখে৷