1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পণ্যের জিআই: এক ভুল আর কতবার করবো আমরা

শামীমা নাসরিন
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়'- টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা এখন ঠিক বাংলা এই প্রবাদ বাক্যের মত৷

https://p.dw.com/p/4cU80
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি
টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বর্তমান জেলাটির ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি গ্রামে, এ শাড়ির ঐতিহ্য প্র্রায় আড়াইশ বছরেরছবি: Al Mamun

গত ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে এক পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য বলে উল্লেখ এর একে দেশটির ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা জানানো হয়৷ বলা হয়, এক মাস আগেই (২ জানুয়ারি) পণ্যটিকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷  ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগের পক্ষ থেকে ওই স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷

এরপরই বাংলাদেশে শুরু হয় হইচই৷ যে হইচইয়ে অনেকের মত আমার মনেও প্রথমে যে প্রশ্ন জাগে সেটা হলো টাঙ্গাইল শাড়ি কী করে ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের হয়৷  টাঙ্গাইল তো বাংলাদেশের জেলা৷ আর টাঙ্গাইল শাড়ি তো বাংলাদেশের বহু বছরের ঐতিহ্য৷

জিআই স্বীকৃতি আসলে কী? এতে কী সুবিধা হয়? ভারত কীভাবে বাংলাদেশের জেলার নাম যুক্ত একটি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি নিয়ে নিতে পারে? ভারত দাবি করলো আর বাংলাদেশ কোনো করলো না?

সত্যি বলতে এইসব প্রশ্নের বেশিরভাগেরই স্পষ্ট কোনো উত্তর আমারও তখন জানা ছিল না৷ তাই এ নিয়ে অনলাইন ও পত্রিকায় নানা সংবাদ, তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটতে শুরু করি৷ আর তাতেই একে একে আমাদের অজ্ঞতা, অবহেলা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার চিত্র স্পষ্ট হতে থাকে৷

টাঙ্গাইলের শাড়ি লিখে সার্চ দিলে উইকিপিডিয়ায় জ্বলজ্বল করে সেটির পাশে ব্রাকেটে লেখা পশ্চিমবঙ্গ শব্দটি৷ উৎপত্তি স্থল লেখা পূর্ব বর্ধমান ও নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ৷ যদিও উইকিপিডিয়ায় অনেক বিষয়েই অনেক উল্টাপাল্টা তথ্য দেখায়৷

তথ্য ঘাটতে ঘাটতে আরো একটি তথ্য আমাকে বেশ অবাক করেছে৷ সেই ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প বিভাগ টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আবেদন করে৷ প্রথমে আবেদনপত্রে সেটিকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব ওয়েস্টবেঙ্গল' বলে বর্ণনা করা হয়৷ যদিও পরে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল' নামে৷ ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওই আবেদনপত্র প্রকাশ পায়৷ মাঝে পেরিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর, এ সময়ে কোনো বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা ব্যবস্থা নেয়নি৷ ভাবতে কেমন অবাক লাগছে না?

বাংলাদেশই বা কেনো এতদিন নিজেদের ঐতিহ্যবাহী এই পণ্যটির জিআই স্বীকৃতি দাবি করেনি? আবার যখন ভারতের স্বীকৃতি প্রাপ্তির খবর প্রকাশ পেলো তখন কীভাবেই বা মাত্র দুই-তিন দিনের মধ্যে এত তাড়াহুড়ো করে স্বীকৃতি দাবি করে ফেললো?

ভারতের মত বাংলাদেশেও পণ্যের উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে হয়৷ বাংলাদেশে এ আবেদন করা হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগে (ডিপিডিটি)৷

এতদিন স্বীকৃতি দাবি না করার উত্তর হিসেবে ডিপিডিটি কর্তৃপক্ষ মোটা দাগে যে উত্তর দিয়েছে তা হলো, স্বীকৃতি দাবি করার বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে রাখা উচিত ছিল৷ কেউ স্বীকৃতি দাবি করে আবেদন না করলে তারা তো আর স্বীকৃতি দিয়ে দিতে পারেন না৷

আর টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা ভারতে জার্নাল প্রকাশের বিষয়ে জানতে না৷ ২ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক পোস্টের পর বিষয়টি জানতে পারেন৷ তাড়াহুড়ো করে স্বীকৃতির আবেদন করার বিষয়ে তিনি বলেন, "টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে আমাদের ডকুমেন্টেশন রেডি হয়ে গেছিলো৷ রেফারেন্সিংয়ের কাজ চলছিল৷ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই আমরা এমনিতেই এটি জমা দিতাম৷”

স্বীকৃতির জন্য আবেদন তো করা হলো, এবার কী? আমাদের আবেদনে ভারত আপত্তি তুললে কী হবে, তারা তো এরই মধ্যে পণ্যটির স্বীকৃতি পেয়ে গেছে৷ এখন কী তারা সেটা ছেড়ে দেবে? যদি ছেড়ে না দেয় তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?

সুন্দরবনের মধুসহ আরো কয়েকটি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি ভারত পেয়ে গেছে৷ যেগুলো আমাদের পাওয়ার সুযোগ ছিল৷ টাঙ্গাইল শাড়ির বেলাতেও কি একই অবস্থা হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন আমার মাথায় কিলবিল করছিল৷

ইতিহাস বলে, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বর্তমান জেলাটির ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি গ্রামে, এ শাড়ির ঐতিহ্য প্র্রায় আড়াইশ বছরের৷ টাঙ্গাইল এক সময় ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা ছিল৷

দেশ ভাগের পর নানা কারণে টাঙ্গাইলের অনেক হিন্দু তাঁতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান৷ তারা মূলত নদীয়া জেলার ফুলিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের কলোনিতে থিতু হয়ে নিজেরা যে কাজে দক্ষ সেই কাজকেই আঁকড়ে ধরেন৷ দেশ ছাড়লেও নিজেদের দক্ষতাকে তো তারা সাথে করে নিয়ে গেছেন৷ ভারত তাঁতিদের সেই দক্ষতাকেই যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি নিজেদের বলে দাবি করেছে৷

কিন্তু জিআই স্বীকৃতি পেতে শুধু দক্ষতা থাকলেই হবে না৷ বরং ভৌগলিকভাবে উৎপত্তিস্থানের একটি গুরুত্ব আছে৷ আমি অন্তত যা বুঝেছি তাতে এটাই আমার মনে হয়েছে৷ আর টাঙ্গাইল থেকে সব তাঁতি তো আর ভারতে চলেও যাননি৷

টাঙ্গাইলের তাঁতিরা যেমন বলেছেন, এ শাড়ি তৈরিতে টাঙ্গাইল জেলার আবহাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷  সেক্ষেত্রে এ পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দাবিতে তো বাংলাদেশই এগিয়ে আছে৷

একটা সময় জিআই স্বত্ত্বের গুরুত্ব নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা ছিল না কারো৷ আমাদের কর্তাব্যক্তিদের এখনো আছে বলে আমার মনে হয় না৷ শুধু জিআই কেন, কোনো মেধাস্বত্ত্ব নিয়েই বাংলাদেশে কেউ গুরুত্ব দেয় না৷ বরং এখানে যতো পারো চুরি করোর চলই বেশি৷

কিন্তু বিশ্বে মেধাস্বত্ত্বের গুরুত্ব বাড়ছে৷ সবাই ‘কপি' নয় বরং আসল পণ্য চাইছে৷ কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পেলে সেটা আন্তর্জাতিকভাবে ব্র্যান্ডিং করতে সুবিধা হয়৷ আন্তর্জাতিক বাজারে জিআই পণ্যের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি৷ তাইতো জিআই নিয়ে এত তোড়জোড় কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে৷ আর আমরা বসে আছি কবে চোর পালাবে, তবে আমাদের বুদ্ধি খুলবে৷

বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইনও কিন্তু ‘সেই আমাদের জিনিস অন্যরা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে' বলে তাড়াহুড়ো করেই করা হয়েছিল৷ ২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশ মাছ কে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত৷ অথচ এসব পণ্যের জন্য বাংলাদেশ বিখ্যাত৷

এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞার কথাই বলি, আমার মা ‘কনভার্টেড মুসলিম'৷ আর আমার নানা বাড়ির বাকি সদস্যরা দেশত্যাগী হিন্দু পরিবার৷ যারা এখন ভারতের নাগরিক, পশ্চিমবঙ্গে থিতু হয়েছেন৷ নানা বাড়ির সঙ্গে আমাদের বেশ যোগাযোগ রয়েছে৷ মাসি মামীরা প্রায়ই মজা করে বলে "এই তোরা ইলিশ ছাড়ছিস না কোন, আমাদের কী খেতে ইচ্ছা করে না৷” আর ওদের ওখানে বেড়াতে গেলে দু-একখানা ঢাকাই জামদানি নিয়ে যাওয়ার আবদারও থাকে৷ অথচ ওই দুইটি পণ্যের জিআই প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল৷

জামদানি আর ইলিশ হাতছাড়া হওয়া আটকাতে ২০১৩ সালে জিআই আইন পাস হয়৷ দুই বছর পর আইনের বিধিমালা তৈরি করে জিআই পণ্য নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি৷

এখন পর্যন্ত ২১টি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ৷ নথিভুক্ত প্রথম পণ্য জামদানি৷ যদিও ভারতের সঙ্গে জামদানির স্বীকৃতি ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছে৷ ভারত ‘উপাধা জামদানি' নামে জিআই নথিভুক্ত করেছে৷

তাই ভারত যদি টাঙ্গাইল শাড়ির দাবি ছাড়ার বিষয়ে জোর আপত্তি জানায় সেক্ষেত্রে এটাও ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে৷ যদিও এজন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে৷ আইনি পথের পাশপাশি চালাতে হবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও৷ কোন কোন পথে এগোনো সম্ভব তা বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন৷

আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে, এই যে আমাদের সবসময় গড়িমসি, সময়ের কাজ সময়ে না করার অভ্যাস- এসব থেকে কবে বেরিয়ে আসবো আমরা৷ সব কিছু হারিয়ে ফেলার পর অন্যকে দোষারোপ করে আখেরে কোনো লাভই তো হয় না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য