1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মালিক-শ্রমিক, নিয়ন্ত্রণকারী মিলে গড়ে উঠেছে দুষ্টুচক্র’

সমীর কুমার দে ঢাকা
৮ জুলাই ২০২২

ঈদ আসলেই বাংলাদেশে পরিবহণ ব্যবস্থার নৈরাজ্যের চিত্র ফুটে ওঠে৷ কিন্তু এটা তো হঠাৎ করেই হয় না৷ দুই ঈদে বড় সংখ্যক মানুষ গ্রামের বাড়ি যান, আবার ফিরে আসেন৷

https://p.dw.com/p/4DrVp
Bangladesh | People are leaving city to celebrate Eid ul Adha with their family at village
ছবি: Mortuza Rashed/DW

আগে থেকেই তো এটা জানা থাকে৷ তাহলে সড়ক ব্যবস্থাপনা কেন আরেকটু ভালো করা যায় না? কী করলে এটা আরেকটু ভালো হতে পারে সেসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাঃ হাদিউজ্জামান৷

ডয়চে ভেলে : বাংলাদেশে পরিবহণ ব্যবস্থায় এখনও শৃঙ্খলা আনা যায়নি৷ বিশেষ করে উৎসবের সময় অর্থাৎ দুই ঈদে পরিবহন ব্যবস্থা আরও বেশি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে৷ কেন শৃঙ্খলা আনা যায় না?

ড. মোহাঃ হাদিউজ্জামান : পরিবহণ ব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা সেটা সারা বছরই থাকে৷ ঈদের সময় যে অস্থিরতা সেটার অন্যতম কারণ হচ্ছে চাপ৷ ছোট দেশ, জনসংখ্যা বেশি, গণপরিবহনের সংকট ফলে সেখানে অস্থিরতা তো থাকবেই৷ যেখানে চাহিদা যোগানের চেয়ে প্রায় ১০-১২ গুন হয়ে যায়৷ এই ঘাটতির কারণে অস্থিরতা বা নৈরাজ্য বেড়ে যায়৷ এই ঘাটতির কারণে গণপরিবহনের সঙ্গে যারা আছেন তাদের কিছু অংশ সুযোগ হিসেবে নেয়৷ যেহেতু চাহিদা বেশি, সংকট আছে ফলে সুযোগসন্ধানীরা এই সুযোগটা নেয়৷ তাদের টিকিট কালোবাজারী, দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় নৈরাজ্য আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়৷

উৎসবের সময় যে পরিবহণ ভাড়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, এটা নিয়ন্ত্রণ কি খুব কঠিন?

অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ কঠিন না৷ এটা সদিচ্ছার ব্যাপার৷ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিন্তু অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে৷ যেমন বিআরটিএ তাদের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ৷ আর পরিবহণগুলো যেহেতু সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের রাস্তা ব্যবহার করে ফলে তাদের একটা বড় রোল প্লে করার ব্যাপার আছে৷ পুলিশ আছে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ আছে৷ এমন অনেকেই আছে৷ কিন্তু আমি যেটা মনে করি, তাদের সদিচ্ছা দরকার, পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছাও দরকার৷ অর্থাৎ সরকারের সর্বোচ্চ সদিচ্ছা দিয়ে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ এটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব যে কঠিন তা নয়৷ টিকিট যে কালোবাজারি হয়, সেটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট৷ কারা করছে, এটা কারও অজানা থাকার কথা না৷ আইন তো আছে, কিন্তু প্রয়োগটা তো করতে হবে৷  

ঈদের সময় সড়কে যানজট বাড়ে, দুর্ঘটনাও বাড়ে৷ কিন্তু এই নির্দিষ্ট সময়ে বেশি সংখ্যক মানুষ বাড়িতে ফিরবেন সেটা তো সবার আগে থেকেই জানা৷ তাহলে ব্যবস্থাপনা আরও একটু ভালো করতে সমস্যা কোথায়?

ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষের চাপ থাকবে, এটা অনাকাঙ্খিত কিছু না৷ প্রতি ঈদেই ঘুরে ফিরে এই চাপ আসে৷ কিন্তু প্রস্তুতির মধ্যে আমরা ঘাটতি দেখি৷ গণপরিবহণের ঘাটতির বিষয়টি মাথায় রেখেই বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ৷ এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব৷ সেই বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে? ঈদের সময় যানজট, দুর্ঘটনা বাড়ে, কেন বাড়ে? গণপরিবহণের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে ঢাকার লক্করঝক্কর গাড়িগুলো একটু মেরামত করে লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে মহাসড়কে নেমে যাচ্ছে৷ তারাই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে৷ এখন ধরেন যারা বাসের ব্যবসা করেন তারা যদি ঈদের সময় প্রচুর গাড়ি কিনে রাস্তায় নামিয়ে দেয় সেটা কিন্তু তাদের জন্য লাভজনক হবে না৷ কারণ ঈদের এই ভিড়টা কিন্তু ১০-১২ দিনের৷ ফলে একটা গাড়ি এক-দেড় কোটি টাকা দিয়ে কিনে ১০-১২ দিনের জন্য চালালে তাদের তো চলবে না৷ তাহলে বিকল্প কী? বিকল্প এমন হতে পারে, আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যাংক, সচিবালয়ের পরিবহণ পুলে বহু বাস আছে৷ সেগুলো চালানোর জন্য তো লাইসেন্স করা চালকও থাকার কথা৷ তাদের দিয়ে এই স্বল্পকালীন সময়ের চাপটা সামাল দেওয়া যেতে পারে৷ সেটা কঠিন কিছু না৷

পরিবহণ ব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা, এটার জন্য দায় মূলত কার?

আমি মনে করি, এখানে একটা বড় চক্র তৈরি হয়েছে৷ এটা দুষ্টচক্র৷ এখানে মালিক আছেন, শ্রমিক আছেন এবং যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের মধ্যেও কিছু কিছু আছেন৷ এককভাবে কারো উপর দায় চাপানো যাবে না৷ সবাই মিলেই এই দুষ্টচক্র৷ আমি মনে করি, এই চক্রটা ভাঙা উচিৎ৷ কেন ভাঙা উচিৎ? আমাদের বর্তমান সরকার ধারাবাহিক সরকার৷ দীর্ঘদিন ধরে তারা ক্ষমতায় আছেন৷ সরকার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হয় তাহলে দুষ্টুচক্র ভাঙা সম্ভব৷

পরিবহণ দেখার দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানটির বিআরটিএর, সেই প্রতিষ্ঠানটির কি আসলেই এটা দেখার সক্ষমতা আছে? এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে৷ সরকার কেন এই প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিক পথে আনছে না?

বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি আছে৷ জনবলের ঘাটতি আছে৷ শুধু জনবল হলেই চলবে না, তাদের স্মার্ট ও মেধাসম্পন্ন হতে হবে৷ বিআরটিএ একটি হাইলি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন৷ এটা অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো না৷ তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে, ফিটনেস সার্টিফিকেট দিচ্ছে, এগুলো তো হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়৷ যদিও এখানে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি আছেন, কিন্তু মূল কাজটা করে বিআরটিএ৷ অবৈজ্ঞানিকভাবে যে পরিমান যানবাহন রাস্তায় নেমে গেছে, এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে পরিমান স্মার্ট ও মেধাসম্পন্ন জনবল দরকার সেটার একটা ঘাটতি আছে৷ বিআরটিএর বয়স ৩০ বছর হয়ে গেল৷ তারপরও প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই সনাতনী পদ্ধতিতে চলছে৷ এখানে ডিজিটাইজেশনের কথা বলা হয়েছে, অনেক সময় উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে৷ অর্থও ব্যয় করা হয়েছে৷ কিন্তু সুফল পাওয়া যায়নি৷ এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সরকারের ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে৷ এখানে বিভিন্ন কাজ হচ্ছে কিন্তু স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না৷ যতদিন না পর্যন্ত এটা নিশ্চিত করা না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বিআরটিএর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আসছে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না৷

‘পরিবহণ ব্যবস্থায় যে মেরুদণ্ড হওয়ার কথা সেটা ভেঙে গেছে’

সরকারি প্রতিষ্ঠান তো এই বিশৃংখলা রোধ করতে পারছে না৷ তাহলে সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কি বিকল্প কোন উপায় খোঁজা সম্ভব? যারা এই বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন?

বিশ্বে অনেকগুলো মডেল আছে৷ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআরটিএ যেসব সার্ভিস দিচ্ছে তার অনেকগুলোই তাদের হাতে থাকা উচিৎ না৷ এগুলো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ৷ সড়কে যে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনা সেটার মূল কারণ আমার কাছে মনে হয় ফিটনেসহীন যানবাহন৷ অবৈজ্ঞানিক উপায়ে আমরা যেভাবে যানবাহনের অনুমতি দিয়েছি, সেইভাবে কিন্তু আমাদের দক্ষ চালক বাড়েনি৷ সঠিক পদ্ধতিতে লাইসেন্স প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি৷ সরকার কিন্তু চাইলে লাইসেন্স এবং ফিটনেসের দায়িত্ব বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর দিতে পারে৷ এই যে পিপিপি মডেল, এভাবেই কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই কাজ হয়৷ থার্ড পার্টিকে দিলে জবাবদিহিতা থাকে৷ আপনি পছন্দ না হলে ওই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিতে পারেন৷ কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা যতটা কঠিন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করা ততটাই সহজ৷ আমাদের দেশে কিন্তু এখনও যোগ্যতা দিয়ে পদোন্নতির ব্যবস্থা হয়নি৷ এখানে সরকারি চাকরিতে ঢুকলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতি হয়৷ লাইসেন্স বা ফিটনেসের মতো হাইটেকনিক্যাল বিষয়গুলো যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে করানো যায় তাহলে সেখানে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে৷

আপনি বলছিলেন, দুষ্টু চক্রের কথা৷ এই দুষ্টুচক্র বা সিন্ডিকেটের কি এতটাই ক্ষমতাধর যে সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না?

এই দুষ্টুচক্র কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেটা কি জানেন? যারা বাসের মালিক বা বাস নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের মধ্যে একটা অংশ কিন্তু সরকারের মধ্যেও বসে আছেন৷ এ কারণেই এটা একটা বড় চক্র হয়ে গেছে৷ যারা এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা আবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকগুলো কমিটিতেও বসে আছেন৷ তারাই বাসের মালিক, তারাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন৷ ফলে সেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে৷ কারণ আপনি তো সুবিধাভোগী, আপনার তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা না৷

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবস্থার যদি তুলনা করতে বলি, আপনি কি বলবেন?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে যদি তাকাই সেখানে পরিবহণ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে গণপরিবহণ প্রাধান্য পেয়েছে৷ গণপরিবহণকে তারা সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলেছে৷ আমি মনে করি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অনেকটা বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন এই কারণে তারা কখনও গণপরিবহণ, কখনও ব্যক্তিগত পরিবহণ, আবার কখনও বলেছেন যানজটের শহরে মোটরসাইকেলের কোন বিকল্প নেই৷ ফলে তারা খেই হারিয়ে ফেলেছেন৷ আমাদের এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাগুলোতে ননটেকনিক্যাল মানুষ বসে আছেন৷ তারা পদাধিকার বলেই বসেন৷ পরিবহণ হল হাইলি টেকনিক্যাল ও সায়েন্টিফিক একটা জিনিস৷ সেখানে টেকনিক্যাল মানুষের উপস্থিতিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা, সেটা আমরা কখনই নিতে পারিনি৷ ফলে গণপরিবহণ আমাদের পরিবহণ ব্যবস্থায় যে মেরুদণ্ড হওয়ার কথা ছিল, সেটা ভেঙে গেছে৷ এটাকে শৃঙ্খলায় আনা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং৷ কারণ আমরা নিজেরাই এই সমস্যাটা তৈরি করেছি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান