1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ক্ষমতাসীনরা সংবাদমাধ্যমকে সব সময় শত্রু মনে করেছে’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নানা দিক নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি৷

https://p.dw.com/p/3pGoc
মুস্তাফিজ শফি
ছবি: privat

ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে কি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যথেষ্ট হচ্ছে? আপনি নিজেও তো একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছিলেন৷ সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলবেন?

মুস্তাফিজ শফি : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদনের প্রথম উদাহরণ দৈনিক ইত্তেফাকে আবেদ খানের ‘ওপেন সিক্রেট’৷ ওপেন সিক্রেট ছিল মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর সরেজমিন প্রতিবেদন৷ সেটাকে যদি আমাদের প্রথম ভিত্তি ধরি, তাহলে আমি বলবো যে, আমাদের দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেক এগিয়েছে৷

আপনি আমার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কথা বলেছেন৷ আমাদের শুরুর সময়টায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগটা বেশি ছিল না৷ আমাদের প্রথমত, সেরকম প্রশিক্ষক ছিল না৷ লেখাপড়া করার খুব বেশি সুযোগ ছিল না৷ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নামে একটি বিভাগ ছিল৷ বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না৷ আমি নিজে সাংবাদিকতায় পড়িনি, বাংলায় পড়েছি৷ আমি কাজ করতে করতে একেবারে মফস্বল থেকে শুরু করে, সাংবাদিকতার প্রতিটি স্তর পেরিয়ে এখন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি৷

আগে যে সুযোগের অভাব ছিল, এখন কিন্তু সেরকম না৷ এখন সবাই জেনে-বুঝে সাংবাদিকতায় আসছেন৷ তারা জানেন, অনুসন্ধান কীভাবে করতে হয়৷ সমস্যা অন্য জায়গায়৷ শুধু সাংবাদিকতায় নয়, সবক্ষেত্রেই শর্টকাট করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ এই শর্টকাটে জনপ্রিয়তা অর্জন, অতিক্রম করার প্রবণতা, সেই প্রবণতা কিন্তু সাংবাদিকতাকেও পেয়ে বসেছে৷

‘প্রতিবেদনটির গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও কিন্তু অনেক বিতর্ক আছে’

বিশ্বের সাথে তুলনা করলে আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কতটা এগিয়েছে?

শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবেও এই শর্টকাট প্রবণতা আছে৷ আমরা যদি পুলিৎজার পুরস্কারগুলো পর্যালোচনা করি, সেখানেও যে পুরস্কারগুলো পাচ্ছে, সেই বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একেবারে পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না৷ এখানকারও অনেক প্রতিবেদন বৈশ্বিক যে বিভিন্ন সংস্থা আছে, সেখানে বিবেচনার মধ্যে গিয়েছে৷ সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলো'র একটি প্রতিবেদন, যেটা রোজিনা ইসলাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের যে পদক দেয়া হয়েছে, সেখানে জালিয়াতি হয়েছে- এই রিপোর্টটিকে কিন্তু আমি একেবারে বিশ্বমানের রিপোর্ট বলবো৷

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়৷ তা কি বেড়েছে? আইন কি সহায়ক?

আমি এক বাক্যে সহায়ক বলবো না৷ আইনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে৷ ২০১৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে৷ এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একদিকে আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷ আবার অন্যদিকে আমি বলবো, এই আইনটির কারণে আমরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়েছি৷ আরো সতর্ক হয়েছি৷ ফলে এই আইনটির পরও যারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছেন, তারা সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা আরো বেশি পালন করে এগিয়ে যাচ্ছেন৷

বাংলাদেশে কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঝুঁকি বেশি?

বেশি আমি বলবো না৷ ঝুঁকি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সব সময়ই ছিল৷ ভবিষ্যতেও যে থাকবেনা তা আমি বলবো না৷ বৈশ্বিক যে ঝুঁকি সেই তুলনায় বাংলাদেশে ঝুঁকি কম বলে আমি মনে করি৷ কারণ, বাংলাদেশে তো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা করতে হচ্ছে না৷

এর বাইরে আর কোনো ঝুঁকি এখানে আছে কিনা...

আমি আইনের বিষয়টি আবারও বলতে চাই৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিন্তু আমরা বিরোধী নই, আইনটির প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু সম্পাদক পরিষদের যে স্ট্যান্ড, এই আইনের কিছু নিবর্তনমূলক ধারা আছে৷ সেগুলোতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা মনে করেছি৷ সেই মনে করাকে এখনো আমি মনে করি সঠিক৷ ওই ধারাগুলোকে বাতিল ও সংশোধন করে সাংবাদিকতা সহায়ক করা উচিত৷ আরেকটি ঝুঁকি আছে৷ বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে এখন বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ বিনিয়োগ করেছে৷ তাদের পত্রিকায় সাংবাদিকদের বিছুটা হলেও সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়৷

প্রতিষ্ঠানগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আগ্রহী? তারা কি বিনিয়োগ করে?

আগ্রহ নাই সেটা নয়৷ কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের তো সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ এটা শুধু আমার পত্রিকার কথা বলছি না ৷ আমি এখনকার পরিবেশের কথা বলছি৷ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও এখন পত্রিকার মালিক৷ অনেক এমপি আছেন পত্রিকার মালিক৷ ফলে তার দলের সুবিধা-অসুবিধা তাকে দেখতে হয়৷ তার দলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট হলে তিনি তার পত্রিকার সাংবাদিকদের সেটা দিতে নিরুৎসাহিত করেন৷

সংবাদমাধ্যমের ভেতরেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শক্তি রয়েছে বলে মনে হয়?

সেটা আমার পত্রিকায় নেই৷ অন্য কারো আছে কিনা আমি বলতে পারবো না৷ কিন্তু আমি যখন চিন্তা করি, তখন আমার পত্রিকায় যারা বিনিয়োগ করছেন, তাদের স্বার্থটাকে আমার মাথার মধ্যে নিই৷  কিন্তু এখানে একটি উদাহরণ দিতে চাই, ওয়ান ইলেভেনের সময়, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও কিন্তু ‘সমকাল' রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলেছে৷

এমন কী ঘটেছে যে রাষ্ট্রীয় শক্তি কখনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপতে বাধা দিয়েছে বা ছাপতে দেয়নি বা অনুসন্ধান শুরুই করা যায়নি? আপনার অভিজ্ঞতা কী?

আমরা অনেক সময় পার করে এসেছি৷ আমরা স্বৈরশাসনের সময়ে ছিলাম৷ আমি ৯০-এর আগের কথা বলছি৷ সেই সময়ে সাংবাদিকতা কেমন ছিল তা আমরা সিনিয়রদের কাছ থেকে জানি৷ তার পরবর্তী যে সময়টি, তার অবস্থা আমি বলবো, ওই সময়ের চেয়ে ভালো৷ তারপরে সেনা সমর্থিত সরকার পার হয়ে আমরা এখন গণতান্ত্রিক সরকারে বাস করছি৷  আমি জোর দিয়ে বলছি, যারা পত্রিকার মালিক তারা ব্যবসা করবেন, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করেন, তাহলে স্বাধীন সাংবাদিকতা বিঘ্নিত হয়৷

কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার মতো প্রতিবেদন করে না বা করতে সাহস করে না...

আমি ওইভাবে তুলনা করতে চাই না৷ আল-জাজিরার যে বিষয়টি বলছে ওটা তো বিতির্কিত একটি বিষয়৷ প্রতিবেদনটির গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও কিন্তু অনেক বিতর্ক আছে৷ বলা হচ্ছে, দুই বছর ধরে অনুসন্ধান করা হয়েছে৷ কিন্তু দেখবেন অনেক গ্যাপ৷ দুই বছর অনুসন্ধানে, একটি প্রোপাগান্ডা তো দুই বছরের অনুসন্ধানী রিপোর্ট হিসেবে প্রচার হতে পারে না৷

সাংবাদিক, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য কোনো সুরক্ষা আইন বা রাষ্ট্রের কোনো সহায়তার দরকার আছে কি না?

আমাকে কেউ আলাদাভাবে সুরক্ষা দেবে এটা আমি মনে করি না৷ আমি মনে করি, আমার বিরুদ্ধে যে আইনগুলো আছে, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে নিবর্তনমূলক ধারাগুলো আছে, সেগুলো যদি বাতিল হয়, তাহলে আমার সুরক্ষা আমি নিতে পারবো৷ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের অনেক আইন আছে৷ প্রেস কাউন্সিল আইন আছে, ফৌজদারি আইন আছে৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিককে কেন অন্তর্ভূক্ত করতে হবে? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো নিবর্তনমূলক আইন থাকবে না, সেটাই আমার সুরক্ষা৷ এই সুরক্ষা আমি চাই রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে৷

বর্তমান সরকার কি সাংবাদিকতার কোনোভাবে গলা চেপে ধরছে বা অনুসন্ধানী সাংদিকতাকে নানা কৌশলে আটকে দিচ্ছে?

আমি ঠিক এটাকে এইভাবে দেখতে চাই না৷ সবসময়ই ক্ষমতাসীনরা কিন্তু সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যমে শত্রু মনে করেছে৷ সেটা জাতীয় পার্টি বলেন, স্বৈরশাসন যখন ছিল তখন বলেন বা পরবর্তীতে বিএনপি সরকার এসেছিল, আওয়ামী লীগ সরকার এসেছিল, আবার বিএনপি, এখন আবার আওয়ামী লীগ সরকার৷ সবার এই জায়গায় মানসিকতা কিন্তু প্রায় কাছাকাছি৷ তারা মনে করেন যে, তাদের কোনো মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে রিপোর্ট গেলে বোধহয় তাদের পুরো দলের বিরুদ্ধে রিপোর্টটি চলে গেছে, পুরো সরকারের বিরুদ্ধে রিপোর্টটি চলে গেছে৷ এটা আমাদের রাজনীতির একটি প্রবণতা৷ এটা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, শুধু বিএনপির নয়, সবার৷

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন প্রয়োজন? দেশের মানুষ, রাষ্ট্র, সরকারকে কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কোনো সহায়তা করতে পারে?

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়৷ কেন বলা হয়?  আসলে এই গণমাধ্যমই চোখ খুলে দিতে পারে সব কিছুর৷  সেই জায়গায় কেউ যখন সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত হন, তখন মনে করেন, এটা বোধ হয় তার সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তার দলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে৷ কিন্তু ভুল সংশোধন করার জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দরকার৷ আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন না যে কী হচ্ছে, সেই জায়গাটিতে সংবাদপত্র ধরিয়ে দেবে আপনাকে৷ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে স্বাধীন সাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা খুবই জরুরি বিষয়৷ এটা যদি কেউ ব্যাহত করার চেষ্টা করেন, তিনি বুঝে হোক আর না বুঝে হোক তিনি গণতন্ত্রেরই ক্ষতি করছেন৷

২০১৬ সালের ছবিঘরটি দেখুন...

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান