1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে ছাত্র রাজনীতি ছিল, আছে, থাকবে

৩ ডিসেম্বর ২০২১

ছাত্র রাজনীতিকে অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা যত বাড়ছে, ভারতে ছাত্র রাজনীতি তত দম পাচ্ছে৷ অতীতেও তেমনই ঘটেছিল৷

https://p.dw.com/p/43m5J
ছবি: Imtiyaz Khan/AA/picture alliance

বছর দেড়েক আগের কথা৷ অগ্রজ সহকর্মী গৌতম হোড়ের সঙ্গে স্টোরি করতে গিয়েছি দিল্লির সিংঘু সীমানায় তখন অবস্থান শুরু করেছেন কৃষকরা৷ সম্প্রতি যাদের কাছে নতি স্বীকার করে কৃষি আইন বাতিল করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷

আন্দোলন তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে৷ দুপুর রোদে অবস্থানরত কৃষকদের ক্যাম্পে পৌঁছে আলাপ হলো ঝকঝকে পাঁচ-ছয় তরুণীর সঙ্গে৷ তারা সকলেই ওই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত৷ ক্যাম্প করে তারাও বসে আছেন৷ কথায় কথায় জানতে পারলাম সকলেই দিল্লির বিভিন্ন কলেজের ছাত্র-ছাত্রী৷ একজনই কেবল সদ্য কলেজ পাশ করে একটি কর্পোরেট সংস্থায় ইন্টার্নশিপ শুরু করেছে৷ ক্যামেরার সামনেই তিনি জানিয়ে দিলেন, অফিসে বলে এসেছেন, আন্দোলন চালিয়ে যাবেন৷ তার জন্য চাকরি চলে গেলেও তিনি কিছু মনে করবেন না৷

বামমনস্ক এমন হাজার হাজার ছাত্র দেখেছিলাম কৃষক আন্দোলনের মাসছয়েক আগে শেষ হওয়া সিএএ আন্দোলনে৷ গোটা দেশ থেকে আন্দোলনরত নারীদের পাশে দিন-রাত বসে ছিলেন তারা৷ মিছিল করেছেন৷ অবস্থান বিক্ষোভ করেছেন৷ গ্রেপ্তারও হয়েছেন৷ কিন্তু আন্দোলন থেকে সরে যাননি৷

কলকাতার মানুষ হিসেবে এই দৃশ্য অধমের কাছে খুব অস্বাভাবিক নয়৷ সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখেই বড় হয়েছি৷ অগ্রজদের কাছে শুনেছি খাদ্য আন্দোলন থেকে নকশাল আমল, ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ থেকে সিলেবাস মুভমেন্ট-- মাইলস্টোন আন্দোলনের সামনে সবসময়েই থেকেছেন ছাত্ররা৷ আন্দোলন করতে গিয়ে মৃত্যুও হয়েছে তাদের৷ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিজের চোখে দেখা৷ কীভাবে সে সময় ছাত্ররা কৃষকদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, আজ তা ইতিহাস৷

ঠিক যেমন ইতিহাস হয়ে যাবে সাম্প্রতিককালে করোনা এবং লকডাউন আবহে বাম ছাত্র-ছাত্রীদের রেড ভলান্টিয়ার্স৷ নিঃস্বার্থে এখনো তারা মানুষের সেবা করে যাচ্ছে৷ এ-ও কম বড় আন্দোলন নয়৷ নয় কম বড় বিপ্লব৷ হয়ত সে কথা মাথায় রেখেই ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে একাধিক ছাত্রনেতাকে সামনে নিয়ে এসেছে সিপিএম এবং বামপন্থি দলগুলি৷ জেএনইউ-র ছাত্র নেতা ঐশী ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ এসএফআই-এর সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যরা গুরুত্বপূর্ণ আসন থেকে এবার ভোটে লড়াই করেছেন৷ হেরেছেন৷ কিন্তু তা-ই বলে হারিয়ে যাননি৷ আগামীর মূলস্রোতের রাজনীতিতে তারা থেকে যাবেন৷ জমিও তৈরি করবেন নিশ্চয়৷

স্বাধীনোত্তর ভারতের সাত দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্ররা বরাবরই গুরুত্ব পেয়েছেন৷ বাম, অতি বাম, মধ্য বাম এবং দক্ষিণপন্থি রাজনীতিতে অসংখ্য ছাত্র নেতা তৈরি হয়েছেন, পরবর্তীকালে যারা মূলস্রোতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়েছেন৷ রেখাপাত করেছেন৷ প্রকাশ কারাত, সীতারাম ইয়েচুরি থেকে শুরু করে দক্ষিণপন্থি অরুণ জেটলি, নির্মলা সীতারমন, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অতি বামপন্থি অসীম চট্টোপাধ্যায়-- সকলেই ছাত্র আন্দোলনের ফসল৷ পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান যুবনেত্রী হিসেবে হলেও তার বীজ রয়ে গেছে আইন কলেজের ছাত্র আন্দোলনে৷ ফলে অদ্যাবধি ভারতের মূলস্রোতের রাজনীতিতে ছাত্র আন্দোলন যে বিপুল প্রভাব ফেলেছে, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই৷ প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতেও থাকবে কি?

প্রশ্ন কঠিন এবং একাধারে জটিল৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্র আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেছে, এ কথা বলা যায় না৷ সাম্প্রতিক উদাহরণগুলি সে কারণেই একেবারে গোড়ায় লিখে রেখেছি৷ মূলস্রোতের রাজনীতিতে এখনো তেমন কিছু করে উঠতে না পারলেও জেএনইউয়ের ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারকে নিয়ে এখন মূলস্রোতে যথেষ্ট আলোচনা হয়৷ বাম সংগঠনে যখন ছিলেন তখন হতো, কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পরেও হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল এবং প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তরুণ বাম মুখদের যতই তাচ্ছিল্যের চোখে দেখুক, তারা যে জমি কামড়ে পড়ে আছেন, রাজ্যের গ্রাম মফঃস্বলে গেলে তার আভাস পাওয়া যায়৷ ফলে ছাত্র রাজনীতির ধার কমে গেছে, এ কথা বলা যায় না৷ ছাত্র রাজনীতি মূলস্রোতে ঢুকতে পারে না-- এমন মন্তব্যও করা যায় না৷

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

তবে এ-ও ঠিক যে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তো বটেই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও ছাত্ররাজনীতির টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা চলছে৷ কলেজে কলেজে ভোট বন্ধ রেখে সেই প্রক্রিয়াকে আরো গতি দেওয়া হয়েছে৷ বাম আমলেও সে চেষ্টা হয়েছিল৷ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোটের নামে প্রহসন তখনো হয়েছে৷ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শয়ে শয়ে কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন তৈরি করেছে বাম ছাত্র সংগঠন৷ কিন্তু তাই বলে কি বিরোধী কণ্ঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন প্রমাণ করে দেয় কণ্ঠ বন্ধ তো হয়ইনি বরং আরো জোরদার হয়েছিল৷ প্রাথমিকভাবে দুইটি আন্দোলনেরই নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল একাধিক অতি বামপন্থি সংগঠনের ছাত্ররা৷ পরে সেখানে তৃণমূল সংগঠন নিয়ে ঢুকে পড়ে৷ বস্তুত, সে সময় বাম শাসকদের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্র সংগঠনগুলির নেতৃত্বে যারা ছিল, মূলস্রোতের রাজনীতিতে তারা দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সেভাবে উঠে আসতে পারেনি৷

বর্তমান পরিস্থিতিতে কলেজগুলি যখন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দখলে, ভোট কার্যত বন্ধ, তখনও একই ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে৷ মূলস্রোতের রাজনীতিতে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের নেতা সেভাবে উঠে আসছে না৷ দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে৷ কিন্তু উঠে আসছে বিরোধী বামেদের ছাত্রমুখ৷ কারণ, তারা এখন মার খাচ্ছে৷

এটাই বোধহয় ইতিহাসের নিয়ম৷ ভারতের প্রেক্ষিতে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তো বটেই৷ ফলে আপাত চোখে ছাত্র আন্দোলনের আগুন কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেছে মনে হলেও ছাইয়ের নীচে আগুন এখনো জ্বলছে৷ সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলন তা প্রমাণ করে দিয়েছে৷ বাকি কথা ভবিষ্যৎ বলবে৷